Published On Jul 13, 2024
গ্রামে আইনের চেয়ে লাঠি-সোঁটার কথাই বেশি চলে। অর্থাৎ কবি সুকুমার রায়ের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করবার নীতি মুলত আমাদের গ্রামীণ সমাজের নীতি। ভিলেজ পলিটিক্সের দুষ্ট চক্রের শিকার হয়ে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার ‘একে অপরের সাথে অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রতিহিংসা আর অহেতুক দলাদলি, ঝগড়া-বিবাদে’ লেগে থাকে। আপনি গ্রামে গেলে দেখবেন, সেখানে আপন ভাইয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক নাই। একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের অভিযোগ, ঈর্ষা, কোন্দল আর রেষারেষি। ফলে বাঙালির কোনো ভাল প্রতিবেশী ও বন্ধু নেই । গ্রামে্র বেশিরভাগ মানুষ এতই টক্সিক যে, তারা তাদের ব্যাক্তিগত জীবনের থেকে অন্যের জীবন নিয়ে বেশি চিন্তিত। আপনি দাড়ি রাখেন না কেন, কার কোন মা-বোন বোরকা পড়ে না কেন, বয়স হয়ে যাচ্ছে ওমুকের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না কেন, আপনার আশেপাশের মানুষ বিদেশে গিয়ে লাখ লাখ টাকা কামায়, আপনি বেকার কেন? এসব আজগুবি বিষয় নিয়ে তাদের যতো টেনশন।
গ্রামে আপনি এমন কোনো বাড়ি খুজে পাবেন না, যেখানে ভিটে-মাটি, জায়গা-জমি নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ‘এই ফ্যামিলি সেই ফ্যামিলির সাথে’ কোনো একভাবে ঝগড়া লেগেই থাকে। ১ ইঞ্চি জায়গা নিয়ে, বা অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ফাটাফাটি,অশ্লিল ভাষায় গালাগালি,মামলা মোকদ্দমা চলতেই থাকে। এক মানুষ অন্য মানুষের নামে গোপনে প্যাচ লাগিয়ে ঝগড়া বাদিয়ে দেওয়া, কাউকে পছন্দ না হলে তার নামে জায়গায় জায়গায় বদনাম রটিয়ে দেওয়া, এমনকি বিয়ে আসলেও গোপনে প্যাচ লাগিয়ে দেওয়া গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের যেনো এটি নিত্যদিনের কাজ।
আর সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে গ্রামের প্রতিটি চায়ের দোকানে চায়ে চুমুক উঠেই গীবত দিয়ে। কার বৌয়ের বাচ্চা হচ্ছে না, কার মেয়ে কার সাথে লটর-পটর ইত্যাদি থেকে শুরু করে রাজনীতি,অর্থনীতি,খেলাধুলা কোনোটারই গবেষণা বাকি থাকে না এইসব সমালোচনায়; যার অধিকাংশই হল গুজব।
এগুলোকে পোয়ার মেন্টালিটি এফেক্ট বা গরিব মানসিকতা বলা হয়। গরিব মানসিকতার কিছু বৈশিষ্ট্য হচ্ছে - চিৎকার-চেঁচামেচি, আর গলাবাজী করা, মুখে রাজা উজির মারা যাকে বলে। কারো অগোচরে তার সমালোচনা করা, কাউকে দমিয়ে রাখতে বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা, গোপনে অন্যের ক্ষতি করা, যেমন- আপনি যে-কোন পাবলিক প্লেসে গেলে দেখবেন, সেখানে এটা ভাঙ্গা, উঠা ছিরা বা কাটা, বাথরুম বা কোনো দেওয়ালে এটা ওটা লিখা-আঁকা, চলন্ত ট্রেনের দিকে ঢিল মারা ইত্যাদি হলো গরিব মানসিকতার অবদমিত প্রতিক্রিয়া। ‘আমরা বনাম তারা’ নামের এই গরিব মানসিকতা লালিত সংস্কৃতি, আমরা বংশ পরস্পরায় বয়ে চলেছি; তা আমাদেরকে মানুষ থেকে পশুর পর্যায় নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
গ্রামে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- "চোরকে বলে চুরি কর, আর গৃহস্থকে বলে সজাগ থাকিস।" এটা ভিলেজ পলিটিশিয়ানদের মূলনীতি। দেখবেন, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলেও বেশিরভাগ সময় এরা টুপি পরে লম্বা দাড়ি রেখে প্রভাব খাটিয়ে মসজিদ কমিটি ও স্কুল পরিচালনা কমিটির ইত্যাদির প্রধান হয়। কেউ না চাইলেও গ্রামের সালিশের মধ্যমণি হয়। কেউ কিছু করার পিছনে নেতিবাচক কিছু না থাকলেও এরা ঠিকই একাধিক নেতিবাচক কারণ খুঁজে পাবে। এরা বাইরে বাইরে আপনাকে সহযোগিতার আশ্বাস ও বাহবা দিলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই আপনার বিরোধিতা করবে। ধীরে ধীরে গোপনে গ্রামে আপনার বিরোধী একটি পক্ষ দাঁড় করাবে। একটা সময় এরা আপনার অথবা আপনার পরিবারের ব্যাপারে এমন কিছু মিথ্যা কুৎসা রটাবে, যাতে আপনি গ্রামে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এই ভিলেজ পলিটিশিয়ানরা যদি দেখেন, গ্রামে আর কেউ তার চেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে বা ধন-সম্পদে তার চেয়ে বেশী হয়ে যাচ্ছে, তাহলেই নানা ছলচাতুরি করে তাকে বিপদে ফেলেন। তাকে যেভাবেই হোক সর্বসান্ত করার চেষ্টা করেন।
অথচ একসময় কৃষি সমাজে মৌসুমভিত্তিক বিনোদন বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল; পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়নভিত্তিক ক্লাব, থিয়েটার, নাটকের দলসহ নানা ধরনের সংস্কৃতির দেখা মিলত। আজ সেগুলো স্তিমিত বরং গ্রাম্য তরুণ যুবকদের মাঝে সাম্প্রদায়িক কট্টরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি দেখা যায় পাবজি, জুয়া, অনলাইন লুডু কিংবা আইপিএল খেলা নিয়ে বাজি ধরার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে।
গ্রামীন সমাজের প্রায় বেশিরভাগ নিয়মকানুনই অযথা, অহেতুক। কিন্তু গরীব মানসিকতার ভিলেজ পলিটিশিয়ানদের কারণে ঐসব বন্ধ করা সম্ভব না। আবার গ্রামীন সমাজে কোনো বাবা-মা ই সন্তানের বন্ধু হবার চেষ্টা করে না।
পরিশেষে বলতে হয়-চোর,ডাকাত আর কুখ্যাত খুনিদের দেশ নিউজিল্যান্ড। একসময় বৃটিশ শাসিত অঞ্চলের কুখ্যাত লোকদের শাস্তি হিসেবে দ্বীপান্তরে পাঠাতো জন বিচ্ছিন্ন নিউজিল্যান্ডে।এখন নিউজিল্যান্ড পৃথিবীর মধ্যে একটি সুসভ্য জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সুশিক্ষায় পৃথিবীর রোল মডেল।আমরাও পারি নতুন প্রজন্মকে প্রয়োজনীয় শিক্ষায় আলোকিত করে গ্রামীণ গরিব মানসিকতার এফেক্ট কাটাতে এবং ভিলেজ পলিটিক্সমুক্ত একটি সুন্দর গ্রাম গড়ে তুলতে।
#village #politics #socialmedia