Published On Jun 2, 2024
ধর্ষণ একটা লম্বা সুতা, যার এক প্রান্তে আছে ধর্ষণ নামের কর্মটি। কিন্তু এসুতার অন্য প্রান্তটা শুরু হয়েছে্ পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ থেকে; যেমন ‘নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখা, ইভটিজিং, নারীবিদ্বেষী ওয়াজ-্নচিহত, নারীকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, হয়রানি করা’ এইসব কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়দিই শেষমেষ ধর্ষণে গিয়ে পৌঁছায়।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংসারে বাবা সন্তানের সামনেই মাকে প্রহার করছে। অশ্লীল ভাষায় গালাগালিসহ করছে। পান থেকে চুন খসলেই নারীর ওপর নির্যাতন— প্রকাশ্য পারিবারিক কলহের মাঝেই ধীরে ধীরে যে ছেলেটি শিশু-কিশোরের বয়স পেরিয়ে যুবক হয়, তখন তার মাঝে নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ ঠিক তেমনটা প্রতিফলিত হয় না।নারীকে অবলা ভোগ্যবস্তু হিসেবে সে বিবেচনা করে।
আবার লম্পট পুরুষরা বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যান করে এগোয় প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য। এখান থেকেও ধর্ষণের মানসিকতা তৈরি হয়।
আমাদের দেশে দেখা যায়, শতকরা নব্বই ভাগ ঘটনায় নারীটি ধর্ষককারীকে চেনে।
ধর্ষণের অন্যতম কারণ নারী-পুরুষ পরস্পরের শরীর-ও মন সম্পর্কে না জানা ও ভুলভাবে জানা। দেখুন পুরুষের অন্ডকোষে কোটি কোটি মিলিয়ন শুক্রানুর জন্ম হয়। এই শুক্রাণুগুলো পৃথিবীতে জায়গা করার জন্য প্রচন্ড পেশার সৃষ্টি করে পুরুষকে, যে কারণে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাধ্যমে সে আক্রমণাত্মক জ্ঞান শূন্য হয়ে যেতে পারে। কিন্তু নারীর মধ্যে মাসে একটা মাত্র ডিম্ব তৈরি হবার কারণে তার মধ্যে কোন যৌন প্রেশার থাকে না। তাছাড়া কেলেঙ্কারি এবং প্রেগনেন্সি হওয়ার ভয় তো তার আছেই। তার উপর মানসিক আবেগ আর শারীরিক অনুভূতি ধীরে ধীরে জায়গাতে না পারলে নারী যৌনতার জন্য প্রস্তুত হতে পারে না। ফলে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সকল যৌনতাই ধর্ষণে পরিণত হয়।
আমাদের তরুণরা এক অদ্ভুত অবদমন বা মানসিক অস্থিরতা নিয়ে দিন যাপন করছেন। পুরুষের শরীরে যৌন হরমোন তুঙ্গে থাকে ১৯ থেকে 2৬ বছর বয়স পর্যন্ত কিন্তু আমাদের ছেলেরা পড়াশুনা বা চাকরির খোঁজে কিংবা ক্যারিয়ারের কারণে এই সময়টা যৌনতা অবদমন করতে ব্যস্ত থাকে তারা,ফলে প্রাকৃতিকভাবে তারা মানসিক হতাশাগ্রস্ত ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ফলাফল ধর্ষণের এত বিস্তার, যা আজ মহামারী।
===
ভারতের ধর্ষণ নিয়ে চমৎকার একটি নিবন্ধ লিখেছেন বেলজিয়ামের অধ্যাপক জ্যাকব ডি রুভার৷ সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘ভারতে প্রতি ঘণ্টায় তিন জন নারী ধর্ষিত হয় – এই তথ্য জেনে ইউরোপের সংবাদ মাধ্যমগুলো ভুলে যাচ্ছেন যে, ঘণ্টায় তিনজন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন ১২৫ কোটি মানুষের দেশে৷ এক কোটি দশ লাখ মানুষের দেশ বেলজিয়ামেই কিন্তু প্রতি ঘণ্টায় অন্তত একজন ধর্ষণের শিকার হয়৷ ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৬০ লাখেরও কম৷ সেখানে প্রতি ঘণ্টায় ৯ জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়৷
বেলজিয়ামের অধ্যাপক এ সব তথ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, ধর্ষণ শুধু ভারতে নয়, সব দেশেই হয়। জনসংখ্যা অনুপাতে ভারতে অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের তুলনায় ধর্ষণ অনেক কম হয়৷
আমেরিকা ধর্ষণের দিকে বিশ্বে এক নাম্বারে আছে। সেদিন কাগজে পড়েছি- ফ্লোরিডার এক উন্মুক্ত সৈকতে দিনের বেলা শত শত মানুষের উপস্থিতিতে এক নারীকে কলেজের কয়েকজন বখাটে ছাত্র মিলে ধর্ষণ করলেও কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেননি।এই ঘটনা ঘটার সময় কেউ পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগও করেননি। কী ঘটছে তারা দেখেছেন কিন্তু কেউ এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল না, বরং যে যার কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আমেরিকার লোকজনের এই মানসিকতার কারণ এইসব তাদের নিত্য চেনা ঘটনা । ‘‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনে কমপক্ষে একজন নারী হয় ধর্ষণের শিকার হন, নয়ত ধর্ষণের হাত থেকে কোনোভাবে বেঁচে ফিরেন৷ ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের দেশের মিডিয়া থেকে শুরু করে সাধারন জনগন পর্যন্ত প্রতিবাদী হয়, উন্নত দেশগুলিতে তাও হয় না।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ৭টি মুসলিমপ্রধান দেশ- তিউনিসিয়া, মিশর, ইরাক, লেবানন, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং তুরস্ক নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে দেখেছেন-এই ৭টি দেশের মধ্যে তুরস্ক এবং লেবাননের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি খোলামেলা পোশাক পরে, কিন্তু এই দেশ দুটিতে অন্য ৫টি দেশের তুলনায় নারীরা ধর্ষিত হয় একেবারেই কম, পক্ষান্তরে আরব অঞ্চলের বালুকাময় মরু প্রান্তরে বালু ঝড় থেকে বাঁচতে কিংবা রৌদ্রের প্রখর তাপ থেকে রক্ষা পেতে ঐ অঞ্চলের মানুষ বরাবরই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রাখে।কিন্তু এসব বেদুইনদের নারী নির্যাতন সব বর্বরতাকে হার মানায়। বিশ্বে ফিনল্যান্ডের নারীরা সবচেয়ে বেশি যত্রতত্র স্বল্পবসনা হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং মাতালো হয়, তারপরও সে দেশে ধর্ষন নেই বললেই চলে। আমাদের পাহাড়ি নারীরা মাত্র একটি কাপড় ব্যবহার করে শরীরের উপরের ও নিচের অংশ ঢেকে থাকে। কই, সেখানে তো ধর্ষননের কোন রেকর্ড নাই। সুতরাং পোশাকের কারণে ধর্ষন হয় একথা একদম ভুল।
প্রকৃতপক্ষে পোশাক নয়, মানসিক দৃষ্টিভংগির পরিবর্তন দরকার।
অনেকে বলছেন দেশে পতিতালয় সহজলভ্য নয় বলে ধর্ষণ হয়।এই কথার বিপরীতে দেখা যায় -ব্রাজিলে সবচেয়ে সহজলভ্য হচ্ছে মেয়েরা, সেখানে পতিতালয় সবচেয়ে বেশি। তারপরেও ব্রাজিলে প্রতি ঘণ্টায় চারজন১৩ বছরের কম বয়সী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পৃথিবীতে নারীদের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক দেশগুলোর অন্যতম হচ্ছে ব্রাজিল।
যে কোনো সামাজিক অবস্থা, যে কোনো ধরনের ব্যক্তিত্ব বা মানসিকতার লোকই ধর্ষক হতে পারে। এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করার অভিযোগ তুললেন বিশ্বসেরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক–ছাত্রী। আবার টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার শতবর্ষের অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করেছে ১৪ বছরের এক কিশোর! এ থেকে বুঝা যায় যে, বয়স এবং শিক্ষার উপর নির্ভর করে ধর্ষক তৈরি হয় এটাও ঠিক নয়।
ধর্ষককে ক্রসফায়ার বা মৃত্যুদণ্ড, বিশেষ অঙ্গহান িকরলেই যে ধর্ষণ রোধ হবে, এমনটি মনে করা যায় না। কারণ ধর্ষণের অপরাধে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ, গুলি করে হত্যা, ফাঁসি দিয়ে হত্যার দণ্ড নিশ্চিত করা দেশগুলোতে আজো ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি বা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন সম্ভব হয়নি।
#historical #education #bangla